Welcome you to my blog. Please feel free to leave your comment. Thank you for visiting.

Monday 16 May 2016

নজরুল জয়ন্তীতে বিলেতে একখন্ড বাংলাদেশ


সৈয়দ রুম্মান

কৃতজ্ঞতায় কাকে বাঁধবো জানি না, নজরুল জয়ন্তী সন্ধ্যা নাকি স্বয়ং দুখুমিয়াকে যিনি জনম জনম ধরে এমন ঋণের দায়ে বন্দি করে গেলেন কস্মিনকালেও সেই বিহ্ববলতার পিঞ্জর থেকে বের হওয়ার জো হবে না তবে এই না হওয়াটিই বিলেতের নজরুল জয়ন্তী সন্ধ্যাকে করে তুললো মহামহিম যেনো একখন্ড বাংলাদেশ এসে প্রতিস্থাপিত হলো ইস্ট লন্ডনের ব্রাডি আর্ট সেন্টারে নজরুলের বাছাই করা গানের গুঞ্জরণে বিমহিত হয়ে ওঠেন একদল বোদ্ধা শ্রোতা ২৩ মে ২০১৫, রবিবার, বিলেতের সাপ্তাহিক ছুটির দিন ঝুরঝুরে উষ্ণ হাওয়াও ছিলো নজরুল জয়ন্তীর অনুকূলে নজরুল সঙ্গীত শিল্পী পর্ষদ এই মুগ্ধতার আয়োজনে তৃতীয় বাঙলাকে এক অপরিমেয় ঋণের বন্ধনে আবদ্ধ করলেন বিলেতের আধুনিক বাঙলা গানে পরিচিত অনেক সঙ্গীতশিল্পীকে তারা পরিচয় করালেন ভিন্ন এক ঘরাণায় আর নিরীক্ষায় উৎরে গেলেন অধিকাংশ শিল্পীরাই


শুরুতেই নজরুলের এক ঝাঁক বুলবুলি কোরাসে বিমহিত করে গেলেন ব্রাডি আর্ট সেন্টারে অপেক্ষমাণ নজরুল প্রেমীদের সেই রেশ কাটতে না কাটতে নজরুলকে স্বকণ্ঠে স্থান দিতে গিয়ে প্রত্যাশা প্রাপ্তির ব্যবধানকে ঘুচিয়ে দিলেন লুসি রহমান তারপরও তো নজরুল পাঠ থেকে যায় অসমাপ্ত হ্রস্ব পরিসরে রাগ-বৈচিত্র্যের নজরুলকে শোনার আকাঙ্ক্ষা অনিঃশেষই থেকে যায় আর সেখানেই পূর্ণতার ঘৃত ঢালতে হারমোনিয়ামে হাত রাখলেন বিলেতের "ভার্সেটাইল সিঙ্গার" লাবণী বড়ুয়া যে আবহ লাবণ্যে লাবণী চমৎকৃত করলেন তার কোনো শেষ আছে কিনা তা বুঁদ হয়ে থাকা দর্শক-শ্রোতাদের হয়তো কখনো জানা হবে না আর না-জানাই তাঁদের আগামী বছরগুলোতে নজরুল-আসরে টেনে আনবে লাবণীর গায়কীর সেই লাবণ্যের প্রতীক্ষায়ই হয়তো নজরুল সন্ধ্যার শেষে দর্শক-শ্রোতাদের মনের ঠোঁটে ঐকতানে বেজে উঠতে থাকে—"আমি সেই দিন হবো শান্ত"

নজরুল জয়ন্তীর এই সন্ধ্যা যেনো সঙ্গীত পিপাসুদের নিয়ে গেল এক অস্থির প্রকরণের মধ্য দিয়ে সেখানে আবারও স্বকীয়তায় মূর্ত হলেন ফারজানা সিফাত "হে নামাযী আমার ঘরে নামায পড়ো আজ " গানটি গেয়ে ওঠার আগে নজরুলের গান লিখবার পটভূমি দেওয়ার উপস্থাপনাটিও ছিলো মুগ্ধকর তবে "হৃদয়" শব্দের বিতর্কিত (রিদয়) উচ্চারণটি খানিক প্রশ্নের ছাপ রেখে গেছে শব্দটির যথাযথ (রিhদয়) উচ্চারণ সে সন্ধ্যায় তাকে করে তুলতে পারতোঅবিসংবাদিত আর পুরো আয়োজনে চমৎকৃত হবার ঘটনা ছিলো সাইদা তানির কণ্ঠে নজরুল সঙ্গীত শোনা, যিনি বিশেষ করে ফোক গানের জন্যই তৃতীয় বাঙলায় প্রসিদ্ধ কিন্তু নজরুল প্রেমের প্রতিযোগিতায় তিনিও যেনো লাবণীর সাথে নজরুল সন্ধ্যার মুকুট ভাগাভাগিতে উদ্যত ছিলেন তার নিখুঁত নৈপুণ্যে নজরুলের সুর নিয়ে খেলা করাটি অনায়াসেই বুঝিয়ে দেয় তার মৌলিকত্ব

রাগ-সম্রাট নজরুলের জাতীয় কবি অভিধা স্মরণ করতে মঞ্চে এসে উপস্থিত হলেন বিলেতের প্রথিতযশা আবৃত্তিশিল্পী মুনিরা পারভীন তাঁর কণ্ঠ বেয়ে বীরদর্পে বের হয়ে আসা ধ্বনির কারুকাজ নজরুল জয়ন্তীকে দিলো পূর্ণতার মাত্রা মানুষের সাম্যে আজীবন যোদ্ধা নজরুলকে মুনিরা তার কণ্ঠের যাদুতে নিগূঢ়ভাবে দর্শক-শ্রোতার হৃদয়ে বসিয়ে দিলেন; বারবার অনুরণন হলো—“মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান আর এই মানুষ মানবতার প্রেমী নজরুলের সৃষ্ট কীর্তনের ঐন্দ্রজালিক সুরে মোহাবিষ্ট করে রাখলেন চিরহরিৎ প্রাজ্ঞ সঙ্গীতশিল্পী গৌরী চৌধুরী যেনো সুচারুভাবে নজরুলের প্রকৃত প্রতিচ্ছবিকেই এঁকে যাওয়া আর এই অংকনের মাঝে নৈপুণ্যে যুক্ত ছিলেন মিতা তাহের রুকসানা সাফা নাতিদীর্ঘ নজরুল বন্দনাসহ হিমাংশু গোস্বামীর গানও ছিলো উপভোগ্য

তবে কোন এক অজ্ঞাত কারণে বিলেতের সুপরিচিত কণ্ঠশিল্পী পরশ মনির সহজিয়া উপস্থিতির অভাব ছিলো চোখে লাগার মতো; প্রত্যাশা প্রাপ্তির ব্যবধান যেনো অপার বেদনায় মূর্ত হয়ে ওঠে যদিও দীর্ঘ পরিচিতির কারণে অনেক দর্শক-শ্রোতাদের কাছে তিনি ছিলেন ঘুমোঘোর রাতে জ্বলজ্বলে তারা আর সেই একই পথে নাজমুন তন্বী উৎরে গেলেও সুজানা আনসার কেনো যেন নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি তবে নজরুল জয়ন্তীর আয়োজকদের একজন হবার কারণে তন্বী অশেষ ধন্যবাদার্হ

নজরুলকে নিয়ে নিরীক্ষার প্রয়াসকে কখনোই খর্ব করা উচিত নয়, আর সে নিরীক্ষা যদি হয় প্রস্তুতি ছাড়া তবে সেটি নজরুল-প্রেমীদের জন্য একটু বিব্রতকরও হতে পারে পূর্ব প্রস্তুতির অভাবে গিটার হাতে মঞ্চে উঠে আসা পরাগ হাসানের উপস্থিতিতে তেমনই এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, সেটি নজরুল সন্ধ্যার মাধুর্যকে কিছুটা হলেও ম্লান করতে উদ্যত ছিলো যদিও শেষের দিকে তিনি নিজেকে অনেকটাই গুছিয়ে নিতে পেরেছেন আয়োজকদের মনন সাবলিলতার পরিচায়ক হিশেবে যুক্ত করা নৃত্য বহুমাত্রিক নজরুলের উপস্থিতিকে নিবিড় মাধুর্যে আরও জ্যোতির্ময় করে তোলে, সন্ধ্যাটিকে নিয়ে যায় অনিন্দ্য নান্দনিকতার শীর্ষে তবে "বিদ্রোহী" কবিতা আবৃত্তির সাথে নৃত্যটি চমকপ্রদ হলেও আবৃত্তিতে যথাযথ স্বর প্রক্ষেপণ, স্বর বৈচিত্র্য আবেগের উপস্থিতির অপ্রতুলতা ছিলো আয়োজকদের দাবি অনুযায়ী বিলেতে প্রথমবারের মতো নজরুলকে নিয়ে এই আড়ম্বর আয়োজনটি ছিলো ঈর্ষনীয়; যদিও বিভিন্ন অনুষঙ্গে দুয়েকবার তার গাম্ভীর্য কিছুটা হোঁচট খেয়েছে তারপরও পুরো সন্ধ্যা জুড়ে নজরুলের একচ্ছত্র আধিপত্য উপস্থিত ছিলো রেজওয়ান মারুফ ইয়াসমিন মাহমুদ পলিনের উপস্থাপনায় আর সেই একই পথে গেলেন যন্ত্রশিল্পীরাও বৈচিত্র্যময় নজরুলের সুর-সম্রাজ্ঞী ফিরোজা বেগম ত্রস্ত নিঃশ্বাসে চলে গেলেও এই নজরুল সন্ধ্যা কোনো এক প্রবহমান ঐন্দ্রজালিক মোহাবিষ্টতায় বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে থাকে, "আমি চির তরে দূরে চলে যাবো, তবু আমারে দেবোনা ভুলিতে

না, নজরুল নিজেই সেই ভুলে যাওয়ার অবকাশটুকু দিয়ে যাননি বরং রাগপ্রধান থেকে শ্যামা সঙ্গীত, ভক্তিমূলক থেকে ইসলামী সঙ্গীত কিংবা বাউল, মুর্শেদী, কীর্তন, কাজরী, সাঁওতালী, ঝুমুরসহ আরও অনেক সুর, শাখা বিষয়ের উপর নজরুলের সঙ্গীতের জগত বাঙালির আত্মা মননকে অহর্নিশ পরিবেষ্টিত করে আছে তার একটি ফল্গু ব্রাডি আর্ট সেন্টারে আয়োজিত নজরুল জয়ন্তী সন্ধ্যায় এসে তন্বী নয়নে বহ্নি ছড়িয়ে বুঁদ করে দিলো পরবাসী প্রাণে প্রাণে গড়ে তোলা একখন্ড বাংলাদেশকে

সৈয়দ রুম্মানঃ  কবিআবৃত্তিশিল্পী  টিভি উপস্থাপক। 

No comments:

Post a Comment

Comment