সৈ য় দ রু ম্মা
ন
বাঙলা বর্ষপঞ্জির বা বাঙলা নববর্ষের উৎপত্তি নিয়ে যতই বিরোধ থাক না কেনো কিংবা এর প্রবর্তন সম্রাট আকবর অথবা নবাব মুরশিদ কুলি খানের হাত ধরেই হোক, আমরা একটা জায়গায় এসে এক হতে পারি আর সেটি হলো এই নববর্ষের উৎসব “পহেলা বৈশাখ” বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য চিন্হায়ক, ঐতিহ্যভিত্তিক বাঙালির এক জাতীয় দিবস: বাঙালির বাঙলা নববর্ষ। যদিও সম্রাট আকবরের প্রবর্তিত বাঙলা বর্ষের পহেলা বৈশাখ ছিলো গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১০ বা ১১ই এপ্রিল। আর এখন পহেলা বৈশাখ পালিত হয় বাংলাদেশে ১৪ই এপ্রিল। অর্থাৎ ইতোমধ্যে বাঙলা পঞ্জিকার প্রথম দিনের তারিখটি ৪ বা ৫ দিন পিছিয়ে গেছে। ৪০০ বছরে বাঙলা পঞ্জিকার এ ব্যবধানের ছোঁয়া লেগেছে এ বিলেতেও, যার আরেক নাম বলা হয় “তৃতীয় বাঙলা”। এই তৃতীয় বাঙলায় পহেলা বৈশাখের বিশাল আয়োজন হয় ইস্ট লন্ডনে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের মে অথবা জুন মাসের কোনো এক রবিবারে। বাঙলা ভাষা আর সংস্কৃতির টানে ব্রিটেন সহ ইউরোপের বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙলা ভাষাভাষীরাই প্রধানত পাড়ি জমান আলতাব আলীর শহর ইস্ট লন্ডনে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। প্রবাসী বাংলাদেশী ও বাঙলা ভাষাভাষীদের কাছে ইস্ট লন্ডনের এই বোশেখের উৎসব ‘বৈশাখী মেলা’ নামে হয়ে উঠতে চায় তাঁদের মিলনমেলা।
বিলেতের বৈশাখী মেলা মালটিকালচারালিজমের লজ্জা: সৈয়দ রুম্মান |
গত ২২ জুন অনুষ্ঠিত বৈশাখী মেলার আয়োজনটা প্রতিবারের মতোই ছিলো জাঁকজমক পূর্ণ। ইস্ট লন্ডনের ভিক্টোরিয়া পার্কে ঢোকার আগেই বুঝতে অসুবিধা হয় নি যে আজ বাঙালিদের মাঝে কিছু একটা হতে চলেছে। মাইল-এন্ড আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে ভিক্টোরিয়া পার্কে প্রবেশের আগ পর্যন্ত রঙবেরঙের শাড়ি ও পাঞ্জাবি পরে দল বেঁধে বাঙালিরা ছুটছিলেন মেলায়। শিশুদের চোখেও খেলা করছিলো অনিন্দ্য আনন্দ! মেলার ভিড়টা মূলত বাড়তে থাকে বেলা বাড়ার সাথে সাথেই। অনেক দর্শকরাই এসেছিলেন তাঁদের প্রিয় তৃতীয় বাঙলার কণ্ঠশিল্পী কায়া, রওশন আরা মনি, সাজেদা কামাল শেফালি, রুবাইয়াৎ জাহান, লাবণি বড়ুয়া, হাসি রানী, হিমাংশু, মাহবুবুর রহমান শিবলু, নাজমুন খান তন্নি, মাহবুবুর রহমান সবুজ, সাইদা তানি, দেলোয়ার হোসেনের গান শুনতে। আবার অনেকেই শেষাবধি অপেক্ষা করেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ভারতীয় কণ্ঠশিল্পী কুমার শানু ও বাংলাদেশের বর্তমানের জনপ্রিয় ব্যান্ডদল “শূন্যের” জন্য। তানজিনা, আমিন রাজা আর খানিকটা কৃত্রিমতায় দুষ্ট হলেও উপস্থাপিকা নাদিয়া আলীর প্রাণোচ্ছল উপস্থাপনায় সবকিছুর ঊর্ধে এ যেনো ছিলো ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সম্প্রীতি ও ঐক্যচেতনার প্রতীক হিশেবে তৃতীয় বাঙলার বাঙালি জাতির এক সর্বজননীন মহোৎসব।
তবে সাত সমুদ্র পেরিয়ে আসা বাঙালির ঐতিহ্যভিত্তিক এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিক মিলনমেলা প্রবাসী বাঙালিদের হৃদয়ে সম্প্রতি জাগিয়ে তোলেছে এক গভীর বেদনা। মাল্টিকালচারালিজমের নামে এই তথাকথিত বৈশাখী মেলায় প্রায়শই দেখা যায় বাঙলা সংস্কৃতির বলাৎকার যার ব্যতিক্রম এবারও হয় নি। মেলায় আসা সিংহভাগ দর্শকদের এবারও হতাশা ও লজ্জা নিয়ে ফিরে আসতে হলো। যেখানে পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করার কথা সেখানে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী একটি বিশেষ ভাষার সংস্কৃতি নিয়ে চলে উদ্দাম নৃত্য। এবারের মেলার আয়োজনটাও সব শেষে কতোটুকু বাঙালি সংস্কৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছে সে প্রশ্ন বেদনা হয়ে থেকে গেছে মেলায় আগত সিংহভাগ দর্শকদের কাছে। ঐতিহ্যগতভাবে সমৃদ্ধ বাঙলা সংস্কৃতিকে কেউ যেন সুকৌশলে হত্যা করতে চেয়েছে। ফ্যাশন শো’র নামে হিন্দি গান দিয়ে বাঙলা সংস্কৃতি পিপাসু দর্শকদের সাথে করা হয় প্রতারণা ও উপহাস। যেখানে এই তৃতীয় বাঙলা তাঁর নিজস্ব বাঙালি কণ্ঠশিল্পীতে স্বয়ং সম্পূর্ণ সেখানে ঐতিহ্যবাহী বাঙলা ভাষার গানকে উপেক্ষা করে উপস্থাপন করা হয় হিন্দি গান। অন্তত এই একটি দিন বাঙালি সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করা যেতো এই মাল্টিকালচারাল ব্রিটেনে। আর ব্রিটেন একটি দেশ হিশেবে গৌরবের সাথে ধারণ, লালন এবং অনুপ্রাণিত করে বহু-সংস্কৃতির চর্চাকে কিন্তু বাঙলা ভাষার সংস্কৃতির পাশাপাশি কেবল বিশেষ একটি ভাষার সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করা আমাদের নিজেদের ব্যর্থতা ও লজ্জা বৈ আর কিছু হতে পারে না। এ নির্ঘাত মাল্টিকালচারাল ব্রিটিশ সোসাইটির প্রতি একটি চপেটাঘাত। তবে মেলার সবচেয়ে বড় চমক ছিলো ইংলিশ গায়িকা অ্যালি ফসেটের কণ্ঠে শাহ আব্দুল করিমের গান। তখন পুরো মেলা জুড়ে দর্শকদের চোখে খেলে যায় আনন্দ ও বিস্ময়। কিন্তু পুরো মেলার অনুষ্ঠান জুড়ে চোখে পরে বাঙলা গানের পাশাপাশি হিন্দি গানের উপস্থিতি যেখানে সামঞ্জস্যহীনভাবে ইংলিশ গান ছিলো মাত্র একটি। এমনকি ভারত থেকে আগত শিল্পী কুমার শানু তাঁর ৪টা গানের মধ্যে ১টা গান বাংলায় গেয়েছেন যেখানে তাঁর প্রায় প্রতিটি গানেরই বাঙলা ভার্সন ছিলো। তিনি মঞ্চে এসে যখন প্রথমেই হিন্দি গান দিয়ে শুরু করেন তখন উপস্থিত দর্শকদের বিশাল এক অংশ চিৎকার করতে থাকেন – দাদা, বাঙলা গান হোক, বাঙলা গান হোক! তাঁর দ্বিতীয় গানটা বাঙলায় শুরু করা মাত্রই দর্শকদের মাঝে যে আনন্দের বন্যা বইতে থাকে তা নিমিষেই হারিয়ে যায় তাঁর পরবর্তী হিন্দি গানের তাণ্ডবে। লজ্জা আর অভিমানে অনেক দর্শকই তখন মেলা প্রাঙ্গণ ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হন।
বিলেতের এই বৈশাখী মেলা হতে পারে প্রবাসী বাঙালি কমিউনিটি এবং বহু জাতি ও সংস্কৃতির মৈত্রীর এক মেলবন্ধন। অথচ এর আয়োজকদের সুশৃঙ্খল পরিকল্পনার অভাব ও সাংগঠনিক দুর্বলতা বিলেতের এই বৈশাখী মেলাকে করে তোলেছে মালটিকালচারালিজমের লজ্জার এক প্রতীক হিশেবে।
সৈয়দ রুম্মানঃ কবি, আবৃত্তিশিল্পী ও টিভি উপস্থাপক। সাবেক ভিপি ও গভর্নর, লন্ডন মেট্রপোলিটান ইউনিভার্সিটি।
No comments:
Post a Comment