শেষ বিকেলের রুম্মান চিত্র-সংলাপ—৪
সৈ য় দ রু ম্মা
ন
কবিতার সঙ্গে সংগীতের একটা মিল আছে। রবীন্দ্রনাথ এ মিলের মূলে দেখিয়েছেন ভাব যা কবিতায় প্রকাশ হয় কথায় আর সঙ্গীতে হয় সুরে। তবে কি এই কবিতা ও সংগীতের ভাবের উপর ভর করেই সুরের সঙ্গে কবিতার এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে ? উত্তরের উপসংহার সহজে না টানলেও অনুভব করি—শব্দ, ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও দৃশ্যকল্পের সাথেও কবিতায় এক গোপন সুরের উপস্থিতি। এই সুরের টানে কবিতার প্রতিটি প্রকরণের সাথে হয় সম্পর্ক। এই সুর মনের চোরা কুঠরিতে তৈরি করে ঢেউ; তারা জেগে থাকে জোয়ার-ভাটায়। সংগীতের সুর বাজে কান থেকে প্রাণে, আর কবিতার সুর খেলা করে সমস্ত সত্বায় । কবিতা ও সংগীতে এই সুর গুনতে গিয়ে কবিতা প্রসবকালে কান দুটো প্রার্থনা করে সংগীত; তার নিগূঢ় মূর্চ্ছনায় লেখা হয়ে ওঠে কবিতা। সংগীত সময়টাকে বন্দি করে রাখে কবিতার অন্দরে; পলায়নপর সময় চেতনার শেকল পরে হয়ে উঠতে চায় কবিতা। সে কারণেই আমার সময়গুলো কবিতার কিমিয়ায় ঘুরপাক খাওয়ার পেছনে আছে অনেক গাল-গল্প, আছে নিযুত বন্ধুর পথের উপাখ্যান, আছে কিছু কিছু সুর আর সংগীতের মূর্চ্ছনা, তারা আমাকে লাগামছুট অস্থিরতায় টেনে নেয় কল্পনার গহীন গহ্বরে।
কবিতা ও সংগীতে ফিরোজা বেগম: সৈয়দ রুম্মান |
সংগীতের মূর্চ্ছনায় তেমনি এক সময় ছিল যখন আমি লিখছি। কবি হয়ে ওঠার প্রচন্ড এক তাড়া কাজ করে নিজের ভেতরে। খরস্রোতা মনুর পাড় ঘেঁষে দেখি স্বপ্নের খেয়াঘাঁট, দেখি জলের সাথে পূর্নিমার মিতালি। বাকাট্টা রঙিন ঘুড়িগুলো উঁকি দেয় ইউকেলিপ্টাসের ডগায়। ধীর পদব্রজে মফস্বলের গলি-ঘুপচিগুলো পেরিয়ে শুনি হৃদয়ের ভেতরে হৃদয়ের ওঙ্কার। আমি পড়তে শুরু করি গাছ, ফুল, পাখি, মেঘ, বৃষ্টি ও রোদের ভাষা। সে ভাষা আমাকে টেনে নেয় সময়ের কাছাকাছি। আর সময় এসে ঠাঁই নেয় প্রতিটা পথের শেষে। সময়ের থেমে থাকায় আমি হই অসীম। ছুটতে থাকি ক্রমাগত। এ এক অবাধ্য ছোটা।
ছুটতে ছুটতে একদিন চলে আসা মনুকে পেছনে ফেলে। মফস্বলের সূর্য-সময় পেরিয়ে নাগরিক পথগুলো হয়ে উঠতে থাকে মোস্তফাপুর গ্রামের হেমন্তের আইল। ধানমন্ডি লেইককে মনে করতে থাকি মনু ব্যারেজ। ধানমন্ডির অপ্রশস্ত পথগুলোকে মনে করতে থাকি রঘুনন্দন্পুরের টিলা। কোথাও উঁচুনিচু দেখলেই মনে হয় এই বুঝি কালেনগার পাহাড় সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে । বেড়িবাঁধ হয়ে উঠতে থাকে হাকালুকি হাওড় অথবা কাওয়াদিঘি। আমি লিখতে থাকি একটা কাক-শাবকের মৃত্যুর কাহিনী, লিখতে থাকি টি এস সি চত্ত্বরে বসা তরুণীর খোলা পিঠে হেসে ওঠা বেলিফুল। আমার যাবার পথে দেখি ময়নামতি, দেখি চাঁদপুরের মোহনায় জীবনের বিমুগ্ধ বৈচিত্র। প্রতিটি দিনের শেষে ডাকতে থাকি রাত, আর রাত নেমে এলেই আমি আবারও লুটিয়ে পড়ি আমার ভেতরে— সুর, ছন্দ আর কবিতায়।
এই আমার আমিকে সাথী করে একদিন চলতে চলতে চলে আসা এই দূরের দূরত্বে। টেমসের খানাখন্দে বসে দেখি বেরিবাঁধ, ক্যানারি ওয়ার্ফে বসে দেখি ধানমন্ডি লেইক। ঝিগাতলার গলিগুলো উঠে আসে ব্রিকলেইনে। আমি অনেক কিছুই খুঁজে পাই এই বিলেতে আবার কিছু কিছু পাইনা। আমার আবহানি মাঠ কিংবা টং দোকানগুলো ফিরে আসেনা, ফিরে আসেনা রিক্সার খোলাহুডে বৃষ্টি-বিকেল। আমি আবার যাই অস্থির পথ ধরে। আমি পাতাল-পথের শেষে জেগে উঠি, একত্রিত করি ছন্দ আর শব্দের বিচিত্র চিত্রকে। না পাওয়ায় যান্ত্রিক রাতগুলোর কাছে সমর্পিত হবার চেষ্টায় থাকি উন্মুখ। একটু ফুরসতে সুর ও ছন্দে হয়ে উঠি সেই পুরাতন পিরানের প্রবহমান আমি। এ আমার যত বেড়ে ওঠা, এ আমার যত আঁকিবুকি তার শিথানে অনাদির থেকে জেগে থাকে সুর ও সংগীত। তারা আমাকে এগিয়ে নেয়। তারা হয়ে ওঠে আমার স্মৃতি জাগানিয়া, হয়ে ওঠে চিন্হায়ক।
স্মৃতি ও বিস্মৃতিতে এগুনো আমি, কবিতায় বেড়ে ওঠা দৈনন্দিন যাত্রাপথে এই সংগীত-ই আমার স্ক্র্যাচ, টেনে নিয়ে যায় স্মৃতির অস্থির চিত্রে। তারা প্রতি নিয়তই বাজতে থাকে কানে, কান থেকে প্রাণে। সে বেজে ওঠায় কোনো কোনো কন্ঠ ও সুর যেন হয়ে ওঠে দর্পণ। দেখি ভেসে যাওয়া সমকাল, দেখি সময়, দেখি প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিতে যাওয়া সন্ধ্যা ও সকাল। আর এই সুর ও কন্ঠের অনেকই হয়ে ওঠেন চলতি পথের আত্মীয়। তাঁরা আমার হয়ে থাকেন অহর্নিশ। ভালোবাসা, প্রেরণা ও শক্তি সঞ্চয়ে সবময়ই হই তাঁদের অভিমুখী। যে কবিতার পৃথিবী সৃষ্টিতে তাঁদের কন্ঠের ধ্বনি মিশ্রিত, সে পৃথিবী থেকে তাঁদের এতটুকু জো নেই বিচ্যুত হবার, বিস্মৃত হবার। তাঁদেরকে কখনো না-হয় না-ই বললাম ভালোবাসি, তবুও তো তাঁরা রয়ে যাবেন গোপন গ্রন্থিতে। তাঁদের যাওয়া মানে আমার কাছে ফিরে আসা, আমার কবিতায় ভর করে ভরে তোলা পেপিরাসের পৃষ্ঠাগুলো। তাঁদের দূরে যাওয়া মানে আমার দৃষ্টি পেরিয়ে স্বপ্ন ও বাস্তবতায় চড়ে বেড়ানো। যেখানে তাঁদের উপস্থিতি মানে আরেকটা শেষ বিকেলের গল্প, আরেকটা চিত্র-সংলাপ।
আর এই শেষ বিকলের চিত্র-সংলাপে এসে দেখি সেই তাঁদেরই একজন ফিরোজা বেগম চলে গেলেন সময়ের পৃথিবী ছেড়ে অন্য এক সময়ে। বেদনায় ন্যুব্জ হয়ে ভাবি, তাঁর যাত্রাপথে কতটুকু কষ্টের কাঠখড় তাঁকে পেরোতে হয়েছিলো; তাঁর যে কন্ঠ আমাকে দিয়েছিলো হাসি-রোদ মাখা শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে এই বিভুঁইয়ের যৌবনেও যে দিয়েছিলো কবিতায় সিক্ত অনেক কোজাগরী রাত, সেই কন্ঠকে কি কস্মিনকালেও পেতে হয়েছিলো কাশফুলসমও কোনো বেদনা। বাস্তবতায় সে আজ আমার জানার পরিধিতে নেই, কখনোই আর থাকবে না । তবে তাঁর এই চলে যাওয়া থেকে যাবে বেদনার এক আখ্যান হয়ে। সে বেদনার গভীরতা আরো বেড়ে যাবে যখন থেকে থেকে মনে হবে, আমার সব অদৃশ্য প্রেরণার কথা তাঁকে বলা হলো না, আর কখনই হবে না। বললে তাঁর কেমন অনুভূতি হতো! আর জানা হবে না তাঁর অনুভুতি। বিপরীতে আরেকবার মেনে নিতে হবে, মানিয়ে নিতে হবে নজরুল সংগীতের এই সম্রাজ্ঞীর চলে যাওয়া। নজরুলকে আমি যতটুকু চিনেছি সংগীতে তার উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে ছিলো তাঁর উপস্থিতি। সেই নজরুলের “আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো” গাইতে গাইতে তিনিও চলে গেলেন চিরতরে। তিনি কি ভেবেছিলেন, তাঁরও একদিন চিরদিনের জন্য চলে যেতে হবে অথবা তাঁর কন্ঠের অনুরাগে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল থেকে অনেক দূরে বসে কেউ একজন লিখবে তাঁর চলে যাওয়ার দুঃখগাঁথা। এই দুঃখগাঁথা আজ স্বগোতক্তি হয়েই জড়ো হয় আমার হৃদয়ের গহীনে। একটা থির ধরে থাকা বাতাস এসে লাগে গায়ে। ভেতরটাও কেমন যেন কেঁপে কেঁপে ওঠে। সে মনে করিয়ে দেয়, “ তবু আমারে দেব না ভুলিতে”। আমিও ভাবতে থাকি, কত দূর গেলে তারে চলে যাওয়া বলে। কতটা দূর তবে চলে যাওয়া যায়। চলে গেলেই কি নিয়ে যায় সবই, নাকি আসলেই সে হৃদয়ের চড়া দামে হৃদয়ের নিয়ে গেছে সবই!
না, আমি কিছুই জানতে পারিনা। আজ কল্পনা ও জানার মধ্যে বিস্তর ব্যবধানে আমার আহত হৃদয়ে বাজে এক করুণ বিউগল। অদেখা প্রিয় মুখকে ভেবে মুছি স্যাঁতস্যাঁতে চোখ। অবাধ্য আঙুলগুলোকে দেখি সময়কে ক্রমাগত বন্দি করতে থাকে বিন্যস্ত বর্ণমালায়। আর এভাবেই বদলাতে থাকে আমার দিনপঞ্জিকা। শেষ বিকেলের রুম্মান চিত্র-সংলাপে কবিতা ও সংগীতের মিথস্ক্রিয়ায় সেখানে জেগে থাকে স্মৃতি জাগানিয়া একটি নাম— ফিরোজা বেগম।
সৈয়দ রুম্মানঃ কবি, আবৃত্তিশিল্পী ও টিভি উপস্থাপক। সাবেক ভিপি ও গভর্নর, লন্ডন মেট্রপোলিটান ইউনিভার্সিটি।
No comments:
Post a Comment